Follow

পরিবার, বন্ধু, কাউকে কিছু না জানিয়ে চট্টোপাধ্যায় (এখন ) পাড়ি দিয়েছিলেন। কিন্তু জাহাজ বর্মার রাজধানী রেঙ্গুনে ঢোকার আগেই তাঁকে যেতে হল ‘কোয়ারান্টিন’-এ। সেই সময় কোনও বন্দরে ব্যাধি দেখা দিলে সেখান থেকে জাহাজ অন্য বন্দরে প্রবেশের আগে জাহাজকে বন্দর থেকে কিছুটা দূরে অন্য এক জায়গায় কয়েক দিন রাখা হত। একেই বলা হয় । রেঙ্গুন তখন প্লেগে ভয়ংকর বিপর্যস্ত। বর্মার সাহেবসুবোরা ধরেই নিয়েছিল, প্লেগ ছড়িয়েছে তৎকালীন বম্বের বন্দরে জাহাজে জাহাজে যে কুলিরা কাজ করে, তাদের থেকে। রেঙ্গুন ঢোকার আগেই আর ডেকের অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে শরৎচন্দ্রও গেলেন আটকে। এক জঙ্গলঘেরা জায়গায় কাটালেন নয় নয় করে সাত দিন।

অবশেষে ঢোকা গেল রেঙ্গুন শহরে। হাত একেবারে খালি। সে সময় রেঙ্গুন শহরে একটিমাত্র হোটেল—‘দাদাঠাকুরের হোটেল’। সেখানে থেকেই শরৎচন্দ্র তাঁর মেসোমশাই অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের জেনে শেষমেশ পৌঁছলেন তাঁর কাছে। অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন রেঙ্গুনের নামকরা উকিল। শরৎচন্দ্র দিন আটকে ছিলেন শুনে মেসোমশাই বললেন, ‘‘তুই আমার নাম করতে পারলি না? আমার নাম করে কত লোক পার হয়ে যায়, আর তুই পড়ে ছিলিস করনটিনে!’’

বর্মি শিখে শরৎচন্দ্র যদি বর্মায় ওকালতি করে তা হলে তাকে আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে না, এ কথা শরতের মতিলাল চট্টোপাধ্যায়কে অঘোরবাবু আগেই জানিয়েছিলেন। কিন্তু শরতের আর উকিল হওয়া হল না। কারণ, তিনি বর্মি ভাষার পরীক্ষাতেই করতে পারলেন না।

না হয়েও প্রায় তেরো বছর তিন মাস বর্মায় কাটিয়ে ফেললেন শরৎচন্দ্র। ভিক্ষুর বেশে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন উত্তর বর্মার অলিতে-গলিতে। মিশেছিলেন চোর, ডাকাত, খুনি... হাজারও মানুষের সঙ্গে। বিচিত্র সেই সব অভিজ্ঞতা!

বর্মার নানান জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে শরৎচন্দ্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল সরকারি কন্ট্রাক্টর গিরীন্দ্রনাথ সরকারের। পেশায় সরকারি চাকুরে, কিন্তু তাঁর নেশা ছিল ভ্রমণ। শরৎচন্দ্র বর্মি ভাষা একেবারেই বুঝতে পারতেন না। গিরীনবাবুই তাঁর দোভাষীর করতেন। এক দিন দু’জনে ঘুরতে বেরিয়েছেন। রাস্তায় দেখলেন, মাছ কেনাবেচাকে কেন্দ্র করে এক দল বর্মি মেয়ের সঙ্গে কিছু লোকের ঝগড়া হচ্ছে। গিরীনবাবুকে জিজ্ঞেস করে শরৎচন্দ্র জানলেন, বর্মায় মরা মাছের খুব কদর। জ্যান্ত মেরে খাওয়া নাকি ওদের কাছে অধর্ম। ব্যাপারটা জেনে শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, ‘‘তা হলে দেখছি একদিন গুচ্ছের মাছ মেরে ওদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হবে।’’ উত্তরে গিরীনবাবু বললেন, ‘‘উহুঁ, ওরা এমনি এমনি নেওয়ার পাত্র নয়, যা নেবে পয়সা দিয়ে নেবে। আর যদি বোঝে মতলব খারাপ, সঙ্গে সঙ্গে ফনানে-ছা। মানে জুতোপেটা!’’

শোনা যায়, প্রণয়ঘটিত ব্যর্থতার যন্ত্রণা ভুলতে প্রথম জীবনে হাতে পেলেই শরৎচন্দ্র বেজায় মদ্যপান করতেন। মাঝে মাঝে মদ খেয়ে বেহুঁশও হয়ে পড়তেন। এক দিন শরৎচন্দ্রের বাড়িতে মদ শেষ। কী করা যায়? গভীর রাতে এক বাঙালি বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে চললেন তাদেরই পরিচিত এক বর্মি বন্ধুর বাড়ি আনতে। বর্মি বন্ধুটির হার্টের অসুখ থাকায় তাঁর মদ খাওয়া নিষেধ ছিল। অনেক অনুরোধের পর বন্ধুর স্ত্রী মদের বোতল বের করে দিলেন। এ দিকে শরৎ ও অন্য বন্ধুদের কী খেয়াল হল, তাঁরা মদ খেতে বসে পড়লেন ওই বর্মি বন্ধুর বাড়ির বারান্দাতেই। মদ খাবে না, এই শর্তে সেও আসরে যোগ দিল। স্ত্রীর নজরদারিতে গোড়ায় মদ না খেলেও, ঘুমিয়ে পড়লে বন্ধুদের অনুরোধে যথারীতি মদের গ্লাসে চুমুকও দিয়ে ফেলল। তার কিছু ক্ষণ পরেই হঠাৎ বুক চেপে ধরে বিকট আর্তনাদ, এবং মৃত্যু!

এর পর শরৎচন্দ্র মদ ছে়ড়ে ধরেছিলেন। যে নেশা তাঁর জীবনের শেষ দিন অবধি ছিল। ভাল গান গাইতেন, শরতের গানে মুগ্ধ হয়ে কবি নবীনচন্দ্র সেন তাঁকে ‘রেঙ্গুন রত্ন’ উপাধি দিয়েছিলেন।

রেঙ্গুনের নাকি শরৎচন্দ্রের যাতায়াত ছিল। এক বার একটি মেয়ের কাছে গিয়ে দেখলেন, তার বসন্ত রোগ হয়েছে। তা দেখে বন্ধুরা সকলে ভয়ে পালিয়ে গেলেও শরৎচন্দ্র কিন্তু পালালেন না। পয়সা করে ডাক্তার ডাকলেন, মেয়েটির চিকিৎসা করলেন। এত কিছু করা সত্ত্বেও মেয়েটি বাঁচল না। শরৎচন্দ্র মেয়েটির সৎকারও করেছিলেন।

রেঙ্গুনে করে থাকতেন লোয়ার পোজনডং-এর এক মিস্ত্রিপল্লিতে। সেখানকার মানুষজনের আপদে-বিপদে সাহায্য করা, অসুখে হোমিয়োপ্যাথি ওষুধ দেওয়া, সব মিলিয়ে শরৎচন্দ্র হয়ে উঠেছিলেন মূর্তিমান মুশকিল আসান। শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তা দেখে বন্ধু গিরীন মিস্ত্রিপল্লিকে মজা করে বলতেন ‘শরৎপল্লি’।

এই মিস্ত্রিপল্লিতেই এক অসহায় মেয়েকে সাহায্য করতে গিয়ে শরৎচন্দ্র বিপদে পড়েছিলেন। ওই পল্লিতে থাকত এক দম্পতি। বছরখানেক পর মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পড়লে যুবকটি তাকে ছেড়ে পালায়। মেয়েটির প্রসব বেদনা উঠলে স্থানীয় লোকজন গেলেন শরৎচন্দ্রের সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করতে। শরৎচন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে ডাকলেন। সন্তান প্রসবের পর মেয়েটির দুঃখের কাহিনি শুনলেন ও যুবকটির খোঁজে লোক লাগালেন। খোঁজ পাওয়ার পর শরৎচন্দ্র লোক মারফত যুবকটিকে বলে পাঠালেন, সে যেন তার স্ত্রী ও সন্তানকে গ্রহণ করে। যুবকটি কিন্তু মেয়েটিকে তাঁর স্ত্রী হিসেবে অস্বীকার করল। তারা যে বিবাহিত ছিল না সেটাও জানা গেল। ছেলেটি তখন অন্য এক জায়গায় সংসার পেতেছে।

শুনে বেজায় চটলেন শরৎচন্দ্র। অসহায় মেয়েটিকে বললেন, যুবকের বিরুদ্ধে খোরপোশের করতে। মামলা কোর্টে উঠলে যুবকটি বলল, মেয়েটির সঙ্গে শরৎচন্দ্রের সম্পর্ক আছে। সদ্যোজাত সন্তানটি তার নয়, শরৎচন্দ্রের। আর সন্তান প্রসবের সময় সে কারণেই নাকি শরৎচন্দ্র খরচাপাতি করে ডাক্তার আনিয়েছিলেন। বিচারক সব শুনে ডাক্তারের বয়ান নিলেন। ডাক্তার জানালেন, শরৎচন্দ্র তাঁকে ডাকলেও প্রসবের সময় মেয়েটি তার স্বামীর নাম, মানে ওই যুবকটির নামই করেছিল। যে নাম তার ডায়েরিতে লেখা আছে। বিচারক সিদ্ধান্ত শোনালেন। যুবকটি দিতে বাধ্য হল।

শরৎচন্দ্রের ছিল মাছ ধরার নেশা। বর্মার পেগুতে থাকাকালীন তিনি প্রায়ই যেতেন মাছ ধরতে। এক দিন পুকুরঘাটে গিয়ে দেখলেন, এক সাহেব বেশ তরিবত করে মাছ ধরতে বসেছেন। এ দিকে অল্প সময়ের মধ্যেই শরৎচন্দ্র ধরে ফেললেন একখানা বড় মাছ। তা দেখে ওই সাহেব স্পষ্ট বাংলায় শরৎচন্দ্রের মাছ ধরার করে নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করতে লাগলেন। সুদূর পেগুতে সাহেবের মুখে বাংলা শুনে শরৎচন্দ্র তো অবাক। পরে জেনেছিলেন, সাহেব অনেক দিন কলকাতায় ছিলেন, সেখানেই বাংলা শেখেন। কথায় কথায় সাহেব জানালেন, আজ মাছ নিয়ে বাড়ি না ঢুকলে মেমসাহেব তাঁকে আস্ত রাখবেন না। কারণ, প্রচুর টাকা খরচ করে তিনি রেঙ্গুন থেকে পেগু এসেছেন স্রেফ মাছ ধরার নেশায়। এখন যদি একটাও মাছ নিয়ে যেতে না পারেন, তা হলে লজ্জার কথা। সব শুনে শরৎচন্দ্র হেসে বললেন, ‘‘আপনি কিছু মনে করবেন না, আমার মাছটি নিয়ে যান।’’

পেগুর শিকারি মিস্টার প্যাখামের সঙ্গে শরৎচন্দ্র মাঝে মাঝেই শিকারে বের হতেন। এক বার সবাই শিকারের আশায় ঝোপের মধ্যে অপেক্ষা করছেন। এমন সময় হঠাৎ গুড়ুম শব্দ। দেখা গেল, শরৎচন্দ্র একটা চিল শিকার করে ফিরছেন। সবাই অবাক। শরৎচন্দ্র বললেন, ‘‘ঝোপের মধ্যে জড়ভরতের মত বসেছিলাম। একদল বককে দেখে গুলি ছুঁড়লাম। মরল চিল।’’ তার পর মৃত চিলের ডানা ধরে দেখিয়ে সবাইকে বললেন, ‘‘দেখো। চিলের গায়ে কোথাও গুলি লাগেনি, এ তো গুলির শব্দে হার্টফেল করেছে।’’

রেঙ্গুনের বাড়িতে ছিল তাঁর নিজস্ব একটি লাইব্রেরি। কাঠের এই বাড়িটি তিনি কিনেছিলেন এক ইউরোপীয় সাহেবের কাছ থেকে। এক বার লাগল সেই বাড়িতে। পুড়ে ছাই হয়ে গেল সব কিছু। তার মধ্যেই ছিল ‘’ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি এবং তাঁর নিজের আঁকা বেশ কিছু পেন্টিংও। সব খুইয়ে নিঃস্ব হয়ে শরৎচন্দ্র পথে এসে দাঁড়ালেন, কুকুর ‘ভেলি’ আর পোষা কাকাতুয়া ‘বাটুবাবু’র সঙ্গে।

আক্রান্ত হলেন রোগে। হাত-পা ফুলে যাচ্ছে, । অবস্থা এমন, প্রায়-পঙ্গু পা নিয়ে চলাফেরাই করতে পারেন না। ডাক্তার জানালেন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের কারণেই এই দশা, বর্মা ছাড়লে তবেই এ রোগ সারবে। এ দিকে চিকিৎসার জন্য ছুটি চাওয়া নিয়ে বড়সাহেবের সঙ্গে বচসা বাধল। শরৎচন্দ্র খুব হয়ে তেড়ে গেলেন সাহেবের দিকে। বাঙালি কেরানির ঔদ্ধত্য দেখে সাহেব স্তম্ভিত!

সে দিনই কাজে ইস্তফা দিলেন শরৎচন্দ্র। ফিরলেন দেশে। দেশে ফিরে চেহারায় বদল আনলেন। রেঙ্গুনে থাকার সময় দাড়ি রেখেছিলেন। ঘন ঘন সিগারেট খেতেন। খেলতেন । জীবনচর্চায় ছিল ফরাসি বোহেমিয়ানিজমের প্রভাব। তখন তাঁর গুরু এমিল জোলা। বর্মা থেকে ফেরার কয়েক বছর পর -গোঁফ কামিয়ে ফেললেন। শুরু হল আর এক নতুন জীবন।

তথ্যসূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা

@bengali_convo
@masindia

নিচের হ্যাস ট্যাগ গুলো ব্যবহার করুন:

Sign in to participate in the conversation
Qoto Mastodon

QOTO: Question Others to Teach Ourselves
An inclusive, Academic Freedom, instance
All cultures welcome.
Hate speech and harassment strictly forbidden.