@Bangladesh @arinbasu @arinbasu1 @BengaliBabuspeaketh @iambengaleebabu @bengali_convo @masindia আমি প্রথমে ক্লিমন্ট এটলির প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করি। 'লেবার পার্টি'র নেতা এটলি ১৯৪৫ সালে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ভারতের স্বাধীনতার পরে তিনি যখন ভারতে আসেন, তখন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপাল (নামটা আমি ভুলে গিয়েছি) তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, "গান্ধীজির আগস্ট আন্দোলন তো ১৯৪৪-এর আগেই মিইয়ে গিয়েছিল, তবে তড়িঘড়ি করে ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়ার প্রয়োজন পড়লো কেন?" তার উত্তরে এটলি সুভাষচন্দ্র বসুর নাম করেন। এরপর রাজ্যপাল মশায় যখন ভারতের স্বাধীনতায় গান্ধীর ভূমিকা জানতে চান, তখন এটলি বলেন, "মিনিম্যাল"।
এই হল ঘটনা। এখানে লক্ষণীয়, মাননীয় রাজ্যপাল কিন্তু ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা কেন তড়িঘড়ি করে দিতে হয়েছিল, সেই প্রশ্ন করেছিলেন। তিনি কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে এই প্রশ্ন করেননি। এটলিও কেবল ১৯৪৭-এ দ্রুত স্বাধীনতা দেওয়ার প্রেক্ষিতেই সুভাষচন্দ্রের নাম করেছেন এবং গান্ধীর ভূমিকাকে ন্যূনতম বলেছেন। তিনি ঠিকই বলেছেন; সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ ফৌজ ব্রিটিশ-ভারত সেনাবাহিনীর ভারতীয় সেনাদের বিদ্রোহী করে তুলেছিল যার ফলে সাম্রাজ্য বজায় রাখার প্রধান অস্ত্র সেনাবাহিনীই তখন অসন্তুষ্ট, অপরদিকে বৃদ্ধ ও হৃতসমর্থক গান্ধী সেই পিরিয়ডে বিশেষ কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেননি।
এটলির মন্তব্যকে এই প্রেক্ষাপটে বিচার করতে হবে। কিন্তু আজকাল অনেক ডানপন্থী ভাষ্যকার প্রেক্ষিতটা উহ্য রেখে এই মন্তব্যকে উপস্থাপন করেন, যাতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গান্ধীজির ভূমিকাকে ছোটো করে দেখানো যায়। এটা সর্বৈব ভুল। ভারতের জাতীয় আন্দোলনে গান্ধীজি ছিলেন প্রথম সর্বভারতীয় নেতা। তিনিই "তিন দিনের তামাশা" বলে পরিচিত কংগ্রেসকে প্রকৃত অর্থে ভারতের জাতীয় সংগঠনে পরিণত করেছিলেন। তিনিই দেশকে জনআন্দোলন কাকে বলে তা শিখিয়েছিলেন। অসহযোগ ও আইন অমান্যের মতো অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন, যা আজও সমস্ত দল ব্যবহার করে থাকে।
এবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও গান্ধী-সুভাষ সংঘাত বিষয়ে আসি। তৎকালীন ভারতের জাতীয় কংগ্রেস আজকের মতো কেবল একটি রাজনৈতিক দল ছিল না। স্বাধীনতা আন্দোলন পর্বে কংগ্রেস ছিল নানা মত ও আদর্শের জাতীয়তাবাদী নেতাদের একটি প্ল্যাটফর্ম। ওই প্ল্যাটফর্মে তৎকালীন নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা ছিলেন; এমএন রায়ের মতো প্রাক্তন কমিউনিস্টরা ছিলেন; সুভাষচন্দ্র, নেহেরুজি, জয়প্রকাশ নারায়ণদের মতো অকমিউনিস্ট অথচ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্রের সমর্থকরা ছিলেন আবার বল্লবভাই প্যাটেলের মতো পুঁজিবাদের সমর্থক ডানপন্থী এমনকি মদনমোহন মালব্যের মতো অতি-ডানপন্থীরাও ছিলেন। অনেকটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগেকার আওয়ামী লীগ বা ১৯৭২-৭৬ কালপর্বের জাসদের মতো।
এখন, গান্ধী ও সুভাষের মধ্যে সংঘাত ছিল, তিনি সুভাষকে সর্বতোভাবে অসহযোগিতাও করেছিলেন। কিন্তু এর কারণ কি ব্যক্তিগত আক্রোশ, যেমনটা আমাদের শেখানো হয়? স্বয়ং সুভাষচন্দ্র কিন্তু এর অন্যরকম ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, “বাস্তবে পার্টির অভ্যন্তরের এই সংগ্রামের পিছনে রয়েছে শ্রেণিসংগ্রাম (ক্রসরোডস)।” প্রকৃতপক্ষে, নিজের জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে গান্ধী ভারতের নব্যোত্থিত বুর্জোয়া পুঁজিপতি শ্রেণিরই স্বার্থরক্ষা করতেন। তাঁর সোশালিজম অফ মাই কনসেপশন বইটি পড়লে একথা পরিষ্কার হয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বর্তমান রাজনৈতিক প্রসঙ্গ’ প্রবন্ধে গান্ধী সম্পর্কে লিখেছিলেন “তাঁর আসল ভয় সোশিয়েলিজমকে। তাঁকে ঘিরে রয়েছেন ধনিকরা, ব্যবসায়ীরা। সমাজতান্ত্রিকদের তিনি গ্রহণ করবেন কি করে? এইখানে মহাত্মার দুর্বলতা অস্বীকার করা চলে না।” (বানান অপরিবর্তিত)
অন্যদিকে, পাঞ্জাব ও বাংলার বিপ্লবী নেতারা ছিলেন পেটি-বুর্জোয়া অ্যানার্কিজমের প্রতিনিধি, যারা পুঁজিবাদের বিরোধী। সুভাষচন্দ্র বা ভগৎ সিংয়ের মতো কয়েকজন নেতা আবার তার থেকে এক ধাপ এগিয়ে সমাজতন্ত্রকে সমর্থন করেন। এই আদর্শগত পার্থক্য ও শ্রেণিস্বার্থের সংঘাতই গান্ধীকে সুভাষের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করেছে। ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির আলোচনা এখানে না আনাই উচিত, আদর্শগত ব্যবধানই প্রধান।
গান্ধীজির আদর্শকে আমরা যদি পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখবো একদিকে দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, অপরদিকে দেশীয় বুর্জোয়াদের প্রতি নরম মনোভাব। তাঁর সকল সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের উৎস দেশের মানুষের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, আর তাঁর সকল আপোষ, ভুল ও পশ্চাৎপদতার কারণ বুর্জোয়াপন্থী চিন্তাধারা। তাঁর সকল সিদ্ধান্তকে এই আলোতেই বুঝতে হবে।
১৯৩৮ সালে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনে সুভাষচন্দ্র, গান্ধীজির প্রার্থী পট্টভিকে পরাজিত করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর ভোটের সিংহভাগই ছিল বামপন্থী ও কমিউনিস্টদের ভোট। এছাড়া তিনি সভাপতি নির্বাচিত হতে পারতেন না। আর, তিনি পট্টভিকে কিন্তু বিরাট কোনো মার্জিনে হারাতে পারেননি। তাই, পট্টভি হেরে গেল বলেই গান্ধীজি জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেললেন, এমন নয়।
স্বাধীনতার পর সুভাষচন্দ্র বসু সর্বভারতীয় স্তরে যথোপযুক্ত সম্মান পাননি একথা ঠিক। বহু ক্ষেত্রে তাঁর অবদান মুছে ফেলার চেষ্টাও হয়েছে। তবে এর কারণ স্বাধীনতা পরবর্তী কংগ্রেস নেতৃত্ব, যেখানে বামপন্থী বলতে এক নেহেরু ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। নেহেরুও সুভাষকে তেমন পছন্দ করতেন না। কিন্তু বর্তমান বিজেপি সরকার যে সুভাষকে সম্মান জানাচ্ছে, তা পরিস্কার ভণ্ডামি। স্বাধীনতা আন্দোলন পর্বে সুভাষচন্দ্র বারবার আরএসএসের সাহায্য চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। এমনকি ১৯৪৬ সালে সুভাষের আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাদের মুক্তির দাবিতে সারা ভারতে যে বিরাট গণআন্দোলন হয়েছিল এবং যাতে সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে কংগ্রেস, মুসলিম লিগ, কমিউনিস্ট পার্টি যোগ দিয়েছিল, সেই আন্দোলনেও আরএসএস বা হিন্দু মহাসভা যোগ দেয়নি। আজ বিজেপি যেটা করছে তা হল নেতাজিকে নিয়ে ভোট কেনা। সুভাষচন্দ্র ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষপাতী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে লিখেছেন, "দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুই একমাত্র হিন্দু নেতা যারা মুসলমান সমাজের মন বুঝতেন ও তাদের কাছে টানতে চেষ্টা করেছিলেন"। আর বিজেপি চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক।