শরৎচন্দ্রের সমাজ-চেতনা
শরৎ সাহিত্যকে পূর্বাপর অনুধাবন করলে সেটার মধ্যে চিন্তার কিছু দ্বৈধতা লক্ষ্য করা যায়। ব্যক্তির স্তরে, শরৎচন্দ্র যেখানে ব্যক্তি মুক্তির একজন প্রবল উদ্গাতা; সেখানে পারিবারিক স্তরে, তিনি বেশ কিছু পরিমাণে #রক্ষণশীল; এবং ব্যক্তি ও পরিবার নিয়ে গঠিত যে সমাজ, সেটার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কখনও স্বাধীনতার #অনুরাগী, আবার কখনও রক্ষণশীলতার পক্ষপাতী ছিলেন বলে দেখতে পাওয়া যায়। সমাজের প্রসঙ্গে কখনও তিনি ভাঙনের জয়গান করেছিলেন, কখনও বিদ্রোহের মন্ত্রণা দিয়েছিলেন, আবার কখনও একেবারে বিপরীত প্রান্তে চলে গিয়ে প্রচলিত সামাজিক কাঠামোর সংহতি রক্ষার প্রয়োজনীতার উপরে জোর দিয়েছিলেন। অর্থাৎ, এক কথায় বলতে গেলে, শরৎ সাহিত্যের পরিবেশিত ভাবধারায় পূর্বাপর কোন সামঞ্জস্য দেখতে পাওয়া যায় না; তাঁর এক সময়ের #ভাবনা অন্য সময়ের ভাবনার দ্বারা খণ্ডিত, এবং এক বইয়ের বক্তব্য অন্য বইয়ের বক্তব্যে অস্বীকৃত হয়েছিল বলে দেখা যায়। অবশ্য এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। কারণ, কোন বড় লেখকের মনোজীবনই সবসময় একটা সোজা সরল রেখায় অগ্রসর হয় না। তাঁর জীবনের চলবার পথে বাঁক থাকে, সেই বাঁক কখনও ডাইনে, তো কখনও আবার বাঁয়ে মোড় নেয়; আবার কখনও সেই পথ সম্পূর্ণ উল্টোমুখে ঘুরে যায়। এই অসামঞ্জস্য বা স্বতোবিরোধ লেখককে কখনোই ছোট করে না, বরং শিল্পীর মানসিকতা যে প্রায়শঃ খুবই জটিলতামণ্ডিত, এবং বহু পরস্পর-বিরোধিতার আধারস্থল হয় - সেই সত্যিকেই জানিয়ে দিয়ে যায় মাত্র। চিন্তার অসামঞ্জস্যহীন সরল গতি মাঝারি মাপের শিল্পীর লক্ষণ, কিন্তু একজন মহৎ শিল্পীর ব্যক্তিত্বের বিবর্তনের ছকের ভিতরে কিছু না কিছু আত্মখণ্ডন অবশ্যই থাকবে। এমনকি অনেকে এটাও বলে থাকেন যে, কন্ট্রাডিকশন মহৎ মনের ধর্ম। শরৎ সাহিত্যের এই যে দ্বৈধতা এবং স্বতোবিরোধ - এটার একাধিক কারণ মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের আলোয় নিরূপণ করা সম্ভব; তবে চেষ্টা করলে শরৎচন্দ্রের জীবনীর ছক থেকেই এমন ধরণের অসামঞ্জস্যের কিছু কারণও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
শরৎচন্দ্র হুগলী জেলার এক নির্বিত্ত কুলীন ব্রাহ্মণ বংশে #জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রাঢ়দেশীয় কুলীন ব্রাহ্মণের বহু অন্ধ সংস্কার তাঁর মজ্জার মধ্যে ছিল। নিজের জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি সেগুলোকে কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তিনি যেমন ব্রাহ্মণের উপবীতের মহিমায় বিশ্বাস করতেন; ছোঁয়াছুঁয়ি বাঁচিয়ে চলবার সার্থকতায় #বিশ্বাস করতেন; সন্ধ্যাহ্নিক পূজা-অর্চনা, স্বপাক আহার, স্বপাক আহারের অভাবস্থলে কেবলমাত্র স্বজাতির প্রস্তুত আহার গ্রহণ দ্বারা দৈহিক ও মানসিক শুচিতা রক্ষা করবার চেষ্টা প্রভৃতি ব্রাহ্মণোচিত আচার-প্রথা পালনের সার্থকতায় বিশ্বাস করতেন; জাতপাতের ভেদ মেনে চলায় বিশ্বাস করতেন; তিনি অসবর্ণ বিবাহরীতির প্রতি নিতান্ত কুণ্ঠিত সমর্থন জানিয়েছিলেন - ইত্যাদি নানা ধরণের নিদর্শনের মধ্যে দিয়ে শরৎচন্দ্রের সেই গতানুগতিক সংস্কারানুগত্যের পরিচয় পাওয়া যায়। হিন্দু ঘরের বিধবার পুনর্বিবাহের যৌক্তিকতাতেও তিনি পুরোপুরিভাবে বিশ্বাস করতেন বলে মনে হয় না; কারণ, তাঁর লেখা এমন একটি গ্রন্থেরও সন্ধান পাওয়া যায় না, যেটার কাহিনী-বৃত্তের ঘটনা সংস্থাপনের মধ্যে বিধবার পুনরায় বিয়ে দেওয়ার মত মনোবল তিনি সংগ্রহ করে উঠতে পেরেছিলেন বলে দেখতে পাওয়া যায়। যদিও সেরকম কিছু ঘটানোর সম্ভাবনা তাঁর একাধিক গল্প-উপন্যাসের কাহিনীর মধ্যেই ছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ, তাঁর পল্লীসমাজের রমা ও রমেশের মধ্যকার ভালবাসার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি তাঁর একাধিক ভাষণে ও প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের বিধবাদের প্রতি নিষ্করুণতার সমালোচনা করেছিলেন, কিন্তু তিনি নিজে সেবিষয়ে #বঙ্কিমচন্দ্রের থেকে যে বেশি উদারতা দেখিয়েছিলেন, এমন কোন প্রমাণ কিন্তু পাওয়া যায় না। যদি বলা হয় যে, শরৎচন্দ্রের প্রতি আরোপিত এই সব #অভিযোগ মনগড়া কল্পনামাত্র, সেক্ষেত্রে কিছু কিছু উদাহরণের সাহায্যে অভিযোগগুলির সারবত্তা প্রতিপাদনের চেষ্টা করা যেতে পারে। কিছুক্ষণ আগেই বিধবাবিবাহের প্রতি শরৎচন্দ্রের মনোভাব প্রসঙ্গে পল্লীসমাজের রমা-রমেশের কথা বলা হয়েছে।
ছোঁয়াছুঁয়ি তথা আহারের শুচিতা রক্ষা প্রভৃতি সংকীর্ণচিত্ত অভ্যাসগুলি সম্পর্কে শরৎচন্দ্রের মনোভাব বোঝাবার জন্য তাঁর দুটি উপন্যাসের দৃষ্টান্ত দিলেই যথেষ্ট হবে। সেই দুটি উপন্যাস হল - চরিত্রহীন ও পথের দাবী। চরিত্রহীনে সতীশ মদ্যপ, মন্দ বন্ধুর প্ররোচনায় পড়ে অস্থান-কুস্থানে চলে যাওয়ার অভ্যাসও তাঁর ছিল; কিন্তু দু’বেলা নিয়মমাফিক সন্ধ্যাহ্নিক আচমনাদি ইত্যাদি না করলে তাঁর চলত না। আর মেসের ঝি সাবিত্রীর তো একটা প্রধান কাজই ছিল, রোজ সকাল ও সন্ধ্যায় সতীশবাবুর সন্ধ্যাহ্নিকের জায়গাটা নিকানো, পূজার আসন, কোশাকুশি আর গঙ্গাজল এগিয়ে দেওয়া। শরৎ-সাহিত্যে এত আচারনিষ্ঠার বাড়াবাড়ি এক এক সময়ে আদিখ্যেতা বলেই বলে মনে হয়। বলা যেতে পারে যে, সতীশের চরিত্রকে নিখুঁতভাবে আঁকবার জন্য তাঁর ব্যক্তিত্বের ওই দিকটাকে দেখানোর প্রয়োজন ছিল; কিন্তু এই যুক্তির উত্তরে এটাও বলা যেতে পারে যে, সেক্ষেত্রে লেখকের নিজের আচার-মনস্কতাই তাঁর বর্ণিত চরিত্রের উপরে প্রক্ষিপ্ত হয়েছিল, নয়ত অতদূর বাড়াবাড়ি কখনও সম্ভব ছিল না। কিন্তু এই ছোঁয়াছুঁয়ি বিষয়ে শরৎচন্দ্রের পথের দাবী উপন্যাসের অপূর্ব চরিত্রটি সবচেয়ে বেশি অবাক করে। #হালদার বংশীয় সেই যুবক বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ উপাধিধারী আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন ব্যক্তি ছিলেন, যিনি কলকাতা থেকে জীবিকার প্রয়োজনে তথাকথিত ম্লেচ্ছের দেশ বর্মা মুলুকে বোখা কোম্পানীর চাকরি নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে গিয়েও ছোঁয়াছুঁয়ির শুচিবাই তাঁর আর কিছুতেই ঘুচতে চায়নি। নিজের আচার-বিচারের খুঁতখুঁতেপনায় তিনি বাংলার শুচিবায়ুগ্রস্ত বিধবাকেও হার মানিয়েছিলেন! তিনি নাকি অত্যন্ত মাতৃভক্ত সন্তান ছিলেন, তাই পাছে মায়ের প্রাণে ব্যথা লাগে সেই কারণে ওই দূর দেশে গিয়েও নিজের আহারে-বিহারে ব্রাহ্মণোচিত আচার-পরায়ণতা রক্ষায় সতত সচেষ্ট ছিলেন। সেই ব্যাপারে তাঁর এমনই সতর্কতা ছিল যে, শুচিতার ক্ষেত্রে পান থেকে চুন খসবার জো পর্যন্ত ছিল না! তাঁর মা ছেলেকে প্রাণ ধরে বর্মা মুলুকে আসতে দেওয়ার সময়ে পরিবারের অত্যন্ত বিশ্বাসী পাচক ঠাকুর তেওয়ারীকে তাঁর সঙ্গে পাঠিয়েছিলেন বলে রক্ষা, নইলে অপূর্বর হয়ত সেই ম্লেচ্ছের দেশে যাওয়াই হত না। সেই তেওয়ারী মায়ের বকলমে অপূর্বকে সতত আগলে রাখতেন, আর অপূর্ব তেওয়ারীর বকলমে অকুস্থলে অনুপস্থিত মায়ের কাছে তাঁর নির্ভেজাল শুচিতার নিত্য পরীক্ষা দিতেন। অমনভাবে প্রভু ও ভৃত্য - দু’জনে মিলে রেঙ্গুন শহরের বুকের উপরে হিন্দুয়ানীর একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ খাড়া করে তুলেছিলেন। অপূর্ব খৃষ্টান ঘরের কন্যা ভারতীকে মনে মনে ভালোবাসলেও তাঁর হাতে খেতে-ছুঁতে তাঁর প্রবল আপত্তি ছিল বলে দেখতে পাওয়া যায়। অপূর্ব সরকার মশাইয়ের পরিচালিত ব্রাহ্মণ হোটেলের কদন্ন খেতে রাজি ছিলেন, কিন্তু তবুও তিনি ভারতীর সযত্নে প্রস্তুত আহার্য মুখে তুলতে রাজি ছিলেন না। অতীতের কয়েকজন #সাহিত্য সমালোচকের মতে, অপূর্বর আচারের সেই গোঁড়ামির চিত্র পথের দাবী উপন্যাসের গোড়ার দিকের অনেকগুলি পৃষ্ঠা এমনভাবে জুড়ে রয়েছে যে, ওই এককালীন রাজরোষ নিগৃহীত প্রসিদ্ধ উপন্যাসের বৈপ্লবিকতার স্বাদ সেটার ফলে অনেকটাই ফিকে হয়ে গিয়েছে বললেও চলে। অথচ ওই জিনিসটা কিন্তু পথের দাবীর মত একটা বইয়ের পক্ষে অপরিহার্য ছিল না, শুধুমাত্র শরৎচন্দ্রের অতিরিক্ত আচার-বিচারের ‘বাই’ - ব্রাহ্মণত্বাভিমান - কাহিনীর ধারার ভিতর অনুপ্রবিষ্ট হয়ে সেই বিভ্রাটের সৃষ্টি করেছিল।
শরৎচন্দ্রের বিপ্রদাস উপন্যাসেও ছোঁয়াছুঁয়ির প্রসঙ্গ খুব একটা কম কিছু নেই। শরৎ সাহিত্যে প্রসঙ্গটির উপর্যুপরি অবতারণা পৌনঃপুনিকতার একঘেয়েমিতেও রূপান্তরিত হয়েছে বললে অন্যায় কিছু বলা হয় না। শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ উপন্যাসের ডিহরী প্রবাসী সদাশয় #বৃদ্ধ বাঙালী ব্রাহ্মণ রামচরণ লাহিড়ীর চরিত্র চিত্রণের মধ্যে দিয়ে স্বপাক আহারের মহিমা উদঘোষিত হয়েছে বলে দেখতে পাওয়া যায়। তিনি সচরাচর নিজে রেঁধে খেতেই অভ্যস্ত ছিলেন, পারতপক্ষে অন্যের #রান্না ছুঁয়ে দেখতেন না। ব্রাহ্মদের প্রতি রামবাবুর বিতৃষ্ণার কোন অন্তঃ ছিল না। সেই বিতৃষ্ণা শরৎচন্দ্রের নিজেরও কিছুটা ছিল, তাঁর দত্তা উপন্যাসের রাসবিহারী চরিত্রটি আর গৃহদাহের কেদারবাবু চরিত্রটি সেটার প্রমাণ দেয়। সেখানেও লেখকের অনীহা তাঁর সৃষ্ট ওই দুই চরিত্রে প্রযুক্ত হয়েছিল বললে অন্যায় কিছু বলা হয় না। যাই হোক, #গৃহদাহ উপন্যাসের রামচরণ লাহিড়ী, যাঁরা হিন্দু সমাজের গণ্ডী ত্যাগ করে নিজেরা একটা আলাদা সমাজ গড়ে তুলেছিলেন, তাঁদের তিনি মনে মনে কোনদিনই ক্ষমা করতে পারেননি। কিন্তু গৃহদাহের উপসংহার অংশে দেখতে পাওয়া যায় যে, রামবাবুর আত্যন্তিক স্বজাতিপ্রীতি আর আচারনিষ্ঠার দুর্গপ্রাকার শেষপর্যন্ত তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়েছিল। এক্ষেত্রে শরৎচন্দ্র আর সংস্কারচালিত কোন লেখক হয়ে থাকেননি, বরং সংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে নিরাসক্ত দৃষ্টিতে সমাজপ্রবাহকে লক্ষ্য করবার মত শিল্পীজনোচিত প্রকৃত শক্তিমত্তাই তাঁর মধ্যে প্রকাশিত হয়েছিল। গৃহদাহে রক্ষণশীলতার উপরে প্রগতির জয় হয়েছিল।
কিন্তু কৌলিক সংস্কারের ঊর্ধ্বে শরৎচন্দ্রের ব্যক্তিত্বের আরেকটি দিক অবশ্যই ছিল, সেখানে তিনি বিস্ময়কররূপে স্বাধীন ও মুক্ত প্রকৃতির #মানুষ ছিলেন। তাঁর ভবঘুরে, বাউণ্ডুলে জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতাই তাঁর সেই মুক্তমনা স্বরূপের কারণ ছিল। চন্দননগরে #প্রবর্তক সঙ্ঘের ডাকা একটি আলাপসভায় (১৩৩৭ বঙ্গাব্দ) আলাপচারীতার প্রসঙ্গে তিনি তাঁর প্রথম জীবনের সেই দিকটির একটি অকপট আভাস দিয়েছিলেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, “ #অভিজ্ঞতা না থাকলে ভাল কিছুই লেখা যায় না। অভিজ্ঞতা লাভের জন্য অনেক কিছুই করতে হয়। অতি ভদ্র শান্তশিষ্ট জীবন হবে, আর সমস্ত অভিজ্ঞতা লাভ হবে - তা হয় না। বলেছি - ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক আমাকেও চার পাঁচবার সন্ন্যাসী হতে হয়েছিল। ভাল ভাল সন্ন্যাসীরা যা করেন সবই করেছি। গাঁজা মালপো কিছুই বাদ যায়নি। … বিশ বছর এইটাতে গেল। এই সময় খানকতক বই লিখে ফেললুম। ‘দেবদাস’ প্রভৃতি ঐ আঠার-কুড়ির মধ্যে লেখা। তারপর গান বাজনা শিখতে লাগলুম। পাঁচ বছর এতে গেল। তারপর পেটের দায়ে চলে গেলাম নানা দিকে। প্রচণ্ড অভিজ্ঞতা তাই থেকে। এমন অনেক কিছু করতে হত যাকে ঠিক ভাল বলা যায় না। তবে সুকৃতি ছিল, ওর মধ্যে একেবারে ডুবে পড়িনি। দেখতে থাকতাম, সমস্ত খুঁটিনাটি খুঁজে বেড়াতাম। অভিজ্ঞতা জমা হত। সমস্ত island-গুলা (বর্মা, জাভা, বোর্ণিয়ো) ঘুরে বেড়াতাম। সেখানকার #লোক অধিকাংশ ভাল নয় - smugglers; এইসব অভিজ্ঞতার ফল - ‘পথের দাবী’। বাড়িতে বসে আর্মচেয়ারে বসে #সাহিত্য #সৃষ্টি হয় না, অনুকরণ করা যেতে পারে। কিন্তু সত্যিকার মানুষ না দেখলে সাহিত্য হয় না। ... মানুষ কি, তা মানুষ না দেখলে বোঝা যায় না। অতি কুৎসিত নোংরামির ভিতরও এত মনুষ্যত্ব দেখেছি যা কল্পনা করা যায় না।” এই উদ্ধৃতিটির মধ্যে দিয়ে লেখকের জীবনের যে রূপরেখাটি পাওয়া যায়, সেটা কিন্তু সচরাচর প্রচলিত বাঙালী মধ্যবিত্ত জীবনের ছাঁচের সঙ্গে একেবারেই মেলে না। সেটার জাত-গোত্র সম্পূর্ণভাবে আলাদা। শরৎচন্দ্রের জীবনীর ছাঁচ সম্পূর্ণ ‘unconventional’ বা গতানুগতিকত্বরহিত। তবে সেটাকে শুধু ‘unconventional’ বললেই সবটুকু বলা হয় না, সেটাকে বৈপ্লবিক বলা উচিত। যে মানুষটি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের চলবার পথে সুন্দর-কুৎসিত কালো-সাদা জটিল-অজটিল নানা বিচিত্র বহুমুখী অভিজ্ঞতার উজান ঠেলে এগিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁর গায়ে কৌলিক সংস্কার পুরোপুরি সংলগ্ন হয়ে থাকা কি সম্ভব ছিল? তাঁর জীবনযাপনের ধরনই তো তাঁকে বংশগতির প্রভাব থেকে মুক্ত করবার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সহায়ক হয়েছিল। শরৎচন্দ্র তাঁর জীবনের প্রতিটি স্তরে একজন প্রকৃত শিল্পীর জীবনযাপন করে গিয়েছিলেন; আর একথা বলাই বাহুল্য যে, একজন শিল্পীর জীবনে কৌলিক সংস্কারের লেশ খুব একটা অবশিষ্ট থাকে না, থাকলেও সেটা সর্বসংস্কারমুক্তির আবেগের তলায় চাপা পড়ে নিতান্ত পিষ্ট হয়ে পড়ে।
কিন্তু তবুও শরৎচন্দ্রের সত্তায় ব্রাহ্মণত্বের অভিমান যে ঘুচেও ঘুচতে চায়নি, সেটা এই কারণে যে, তিনি তাঁর সমস্ত বিবর্তন-পরিবর্তনের মধ্যেও সেটিকে সজ্ঞানে সযত্নে লালন করেছিলেন। সেটা সম্ভব হয়েছিল, কিছুটা তাঁর বাল্য ও কৈশোর জীবনের প্রতি মমত্ববশতঃ, আর কিছুটা রাঢ়দেশীয় কুলীন ব্রাহ্মণের মজ্জাগত অনুদারতার জন্য। কথাটা খানিকটা প্রাদেশিক শোনালেও একথা বলতেই হবে যে, শরৎচন্দ্রের মত একজন ব্রাহ্মণের মনোগঠনের ভিতরে অন্ধ আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি আসক্তি, ছোঁয়াছুঁয়ি জাত-বিচারের প্রবণতা, পুরনো রীতিনীতিকে আঁকড়ে থাকবার মোহ প্রভৃতি যুক্তিহীন মনোবৃত্তি প্রায় দিনের সঙ্গে রাত্রি অথবা আলোর সঙ্গে অন্ধকার অচ্ছেদ্যভাবে সংলগ্ন থাকবার মত উচ্চশিক্ষা আর সাংস্কৃতিক পালিশ সত্ত্বেও অস্তিত্বের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে লেপ্টে ছিল। সেই কারণেই শরৎচন্দ্রের ব্যক্তিত্বের মধ্যে এক অদ্ভুত দ্বৈধতার সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়। তিনি নিজের বাস্তব জীবনের বহুমুখী অভিজ্ঞতার দৌলতে একজন সর্বসংস্কারমুক্ত পুরুষ যেমন ছিলেন, তেমনি পক্ষান্তরে কৌলিক স্তরে সংস্কারের হাতে-ধরা বশংবদ প্রকৃতির একটি জীবও ছিলেন। নইলে এমন অবিশ্বাস্য, অসম্ভব ব্যাপার কি করে সম্ভব হয়েছিল যে, যিনি বাংলা সাহিত্যে বিপ্লবী ঐতিহ্যের অনুসরণে অভয়া, কিরণময়ী, সব্যসাচী, কমলের মত অবিস্মরণীয় সব চরিত্রের সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁদের কর্ম ও কথার মধ্যে দিয়ে বিদ্রোহের জয়ধ্বজা উড়িয়ে দিয়েছিলেন; সেই তিনিই আবার তাঁর স্নেহের ভগিনীর কাছে অকপট স্বীকারোক্তি করেছিলেন - “দিদি, আমি কোন কালে খাওয়া ছোঁয়ার বাছবিচার করিনে, কিন্তু মেয়েদের হাতে আমি কোনদিন কিছু খাইনে। শুধু খাই তাঁদের হাতে যাঁদের বাপ মা দু’জনেই ব্রাহ্মণ এবং বিয়েও হয়েছে ব্রাহ্মণের সঙ্গে। ... সমাজভুক্ত হোন তাতে আসে যায় না, কিন্তু ঐ রকম মেশানো জাত হলে আমি তাঁদের ছোঁয়া খাইনে। তাঁরা বলে শরৎবাবু শুধু লেখেন বড় বড় কথা, কিন্তু বাস্তবিক তিনি ভারি গোঁড়া। আমি গোঁড়া নই লীলা, কিন্তু শুধু রাগ করেই এঁদের হাতে খাইনে।” (লীলারাণী গঙ্গোপাধ্যায়কে লিখিত পত্রের অংশ) শরৎচন্দ্রের এই স্বীকারোক্তিমূলক পত্রাংশ থেকে দুটি জিনিস দেখতে পাওয়া যায়। প্রথমতঃ, মুখে অস্বীকার করলেও তিনি খাওয়া-ছোঁয়ার বাছবিচার মানতেন। বাছবিচারের বেলায় ব্রাহ্মণের প্রতি তাঁর বিশেষ পক্ষপাত ছিল। দ্বিতীয়তঃ, কোন একটি বিশেষ সমাজভুক্ত নারীদের প্রতি তাঁর অন্তরের বিরাগ ছিল। #লীলারাণী গঙ্গোপাধ্যায়কে শরৎচন্দ্রের লিখিত সংশ্লিষ্ট #চিঠি ও অন্যান্য চিঠিগুলি (শরৎ-সাহিত্য সংগ্রহ, ত্রয়োদশ সম্ভার দ্রষ্টব্যঃ) পর্যালোচনা করলে একথা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না যে, তিনি সেখানে ব্রাহ্মসমাজের নারীদের কথাই বলতে চেয়েছিলেন। একজন বহুদর্শী বহুশ্রুত মানুষের, বিশেষ করে শিল্পী মানুষের জীবনে ওই ধরণের সাম্প্রদায়িক অনুদারতা থাকাটা যে বাঞ্ছনীয় নয়, সে কথা শরৎচন্দ্রের মত সংবেদনশীল লেখকের থেকে আর বেশী কে জানতেন? কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর সেই সংকীর্ণচিত্ত বিরাগকে ভাষা না দিয়ে থাকতে পারেননি। অতি বড় মহৎ লেখকের জীবনেও যে কত সময়ে কত কুসংস্কার বাসা বেঁধে ফেলে, এটা সেটারই একটা প্রমাণ। এখন এটা নিয়ে আক্ষেপ জানানো চলে, কিন্তু তা বলে হয়কে নয় করা চলে না।
অনেকের মতে শরৎচন্দ্রের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে যে অফুরন্ত মালমশলা ছিল, যে সুবিশাল মানবীয় জ্ঞানের পুঁজি ছিল, সেসব ব্যবহার করে তিনি আরও অনেক বড় লেখক হতে পারতেন; একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী মননশীল লেখকরূপে অসংশয় প্রতিষ্ঠা পেতে পারতেন; কিন্তু শুধু তাঁর সেই অনুদার প্রাদেশিকতা আর সাম্প্রদায়িকতাই তাঁকে সেটা হতে দেয়নি, সেগুলোই তাঁকে সেসব পেতে দেয়নি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সেখানেই তাঁর মৌলিক পার্থক্য ছিল। রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে নিজের জীবনারম্ভ করেছিলেন, তারপরে জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতার অধ্যায়কে সোপানরূপে ব্যবহার করে সেগুলিকে ধাপে ধাপে পেরিয়ে, জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি যেখানে গিয়ে পৌঁছেছিলেন, সেখানে আন্তর্জাতিকতার বিরাট অঙ্গন বিস্তৃত ছিল, ও তাতে বিশ্বের সর্বজাতির মেলা বসেছিল। সেখান থেকে তাঁর জন্মক্ষেত্র জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িকে সুদূর নীহারিকালোকের ধূম্রপুঞ্জের মত অস্পষ্ট আভাসে চোখে পড়ত মাত্র, তবে সেটার থেকে বেশী অনুভব করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু শরৎচন্দ্রের বেলায় তেমন কিছু ঘটেনি। তিনি বর্মা, জাভা, বোর্ণিয়ো ইত্যাদি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি পরিক্রমা করলেও, এবং নিজের জীবনে বিচিত্র-বিপুল-বিবিধ অভিজ্ঞতার শরিক হয়ে অগুণতি মানুষকে চরে খেলেও, তাঁর মনের এক কোণায় কিন্তু আমরণ #হুগলী জেলার #দেবানন্দপুর গ্রামই সংসক্ত হয়ে ছিল। সেখানকার পেছুটান তিনি কোন সময়েই কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তাই তাঁর মধ্যে অত বৈসাদৃশ্য, অত অসামঞ্জস্য, অত স্ববিরোধ দেখতে পাওয়া যায়। তাই তিনি পথের দাবীর মত রাজনৈতিক বিপ্লব আর শেষ প্রশ্নের মত সামাজিক বিপ্লবের বাণীবাহক উপন্যাসের স্রষ্টা হয়েও, বাংলার একজন শ্রেষ্ঠ গার্হস্থ্য জীবনের রূপকার, এবং অতুলনীয় পারিবারিক গল্পোপন্যাসের অমর কথাকার হতে পেরেছিলেন। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হল যে, বাংলার পাঠক-পাঠিকারা তাঁর বৈপ্লবিক রূপটাকে তেমনভাবে নেননি, যেমনভাবে তাঁরা তাঁর সেই সাধারণ সুখ-দুঃখ-বেদনায় ভরা গৃহসংসারের স্নিগ্ধ-মধুর চিত্রগুলিকে নিতে পেরেছেন। তাহলে কি শরৎচন্দ্রের সংস্কারমুক্ত বৈপ্লবিকতা নিষ্ফল হয়েছে? তাঁর সংস্কারানুগত গৃহবদ্ধ পারিবারিক শিল্পীর রূপটাই কি সব কিছুকে ছড়িয়ে বাঙালী পাঠক-পাঠিকার চিত্তজয় করেছে? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া মোটেও সহজসাধ্য নয়। তবে শিল্পের একটি বিচিত্র খেয়াল হল যে, অনেক সময়ে পাঠক-পাঠিকার বিচারে চূড়ান্ত বিপ্লবও উপেক্ষিত হয়, পাঠক-পাঠিকারা তাঁদের গৃহ-সংসারের ছোটখাট সুখ-দুঃখকে সে আঁকড়ে ধরে থাকতে চান, আর তাতেই তাঁরা সমধিক স্ফূর্তি অনুভব করেন। দিগন্তের অভিমুখী বহিরাবেগের থেকে কূপমণ্ডুকতাই যেন তাঁদের বেশী ভাল লাগে, আকাশে হাত বাড়ানো অপেক্ষা তাঁরা যেন গৃহাঙ্গনেই লগ্ন হয়ে থাকতে বেশী পছন্দ করেন। সাগরের উত্তাল তরঙ্গমালায় হুটোপাটি খাওয়ায় তাঁদের আনন্দ নয়, বাড়ির খিড়কি পুকুরের শান্ত স্থির জলে অবগাহন-স্নানেই তাঁদের দেহের আরাম ও প্রাণের তৃপ্তি অনুভূত হয়। শরৎচন্দ্রের শিল্পসৃষ্টিগুলির মূল্যায়ণে অগ্রসর হলে এই মন্তব্যের সার্থকতাই যেন বেশী চোখে পড়ে। শিল্পের মানদণ্ডে তাঁর বিরাজ-বৌ, পল্লীসমাজ, অরক্ষণীয়া, নিষ্কৃতি, পণ্ডিতমশাই, বৈকুণ্ঠের উইল প্রভৃতি পল্লীভিত্তিক পারিবারিক উপন্যাসগুলি যতটা উৎরে গিয়েছে, তেমন সম্ভবতঃ আর কোন উপন্যাস করতে পারেনি। তাঁর লেখা গল্পের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার দেখতে পাওয়া যায়। বিন্দুর ছেলে, রামের সুমতি, মহেশ, অভাগীর স্বর্গ, একাদশী, বৈরাগী প্রভৃতি গল্পের কোন তুলনা হয় না। অথচ সে সব রচনার বিষয়বস্তু কত তুচ্ছ, বহির্জগতে ব্যাপ্ত ভাবনা-ধারণা থেকে সেগুলো কত বিচ্ছিন্ন। যে শরৎচন্দ্র বিপ্লবের বাণীবাহক ছিলেন, সেই শরৎচন্দ্রের চেয়ে সংস্কারাবদ্ধ পারিবারিক অকিঞ্চিৎকর গার্হস্থ্য সুখদুঃখের রূপকার শরৎচন্দ্র বাঙালী পাঠক-পাঠিকার কাছে বেশি প্রিয়। এর থেকে শিল্পের নিজস্ব নিয়মনীতির বৈশিষ্ট্যটাই শুধু ধরা পড়ে। শিল্প ব্যক্তির সুখ-দুঃখ, #প্রেম- #ভালবাসা, ব্যর্থতা, নৈরাশ্য, আশার উল্লাস ইত্যাদিকেই বড় করে দেখে; ব্যক্তির ভাবজীবনকে বা তাঁর আদর্শবাদকে নয়। আদর্শবাদ মননশীলতার বস্তু, পক্ষান্তরে ব্যক্তির ব্যক্তিগত হৃদয়ের সংবাদ অনুভূতির বস্তু। শিল্পের কাছে এই শেষোক্তেরই আদর বেশী। যেহেতু শিল্প ব্যক্তিভিত্তিক, সামূহিক নয়, তাই সেটার কাছে ভাবজীবনের তেমন দাম নেই, যতটা ব্যক্তিগত প্রেমপ্রণয়-আশা-নিরাশার ছবির রয়েছে। শরৎ সাহিত্যের বেলায় এই কথাটা যত অনুভব করা যায়, তেমন সম্ভবতঃ অন্য কোন সাহিত্যের বেলায় করা যায় না। এক্ষেত্রে কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টি সমধিক পরিস্ফুট হতে পারে; এবং সেই সঙ্গে শরৎচন্দ্রের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণাগুলিরও একটা স্পষ্টতর ছবি পাওয়া যেতে পারে।
শরৎ-সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত সকলেই অবগত আছেন যে, তিনি কয়েকটি বিদ্রোহিনী নারীচরিত্রের সৃষ্টি করেছিলেন। সেগুলির মধ্যে শ্রীকান্ত দ্বিতীয় পর্বের অভয়া, তৃতীয় পর্বের সুনন্দা; চরিত্রহীন উপন্যাসের কিরণময়ী ও শেষ প্রশ্নের কমল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। তাঁদের মধ্যে অভয়া আবার সবচেয়ে বেশি বিদ্রোহিনী। তিনি শুধু কথায় বিদ্রোহিনী নন, নিজের আচরণেও বিদ্রোহিনী। অভয়া রোহিণীবাবুর সমভিব্যাহারে বর্মা মুলুকে বিবাহের পর থেকেই নিখোঁজ তাঁর স্বামীর খোঁজ করতে গিয়েছিলেন। সেখানে পৌঁছে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে, তাঁর স্বামী এক বর্মিনীকে বিবাহ করে কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে দিব্যি জমিয়ে বসেছেন। অভয়ার স্বামী #মদ্যপ উচ্ছৃঙ্খল কদর্যরুচি ছিলেন। স্ত্রীর ক্ষীণতম স্মৃতিও তাঁর মনে আর জাগরূক ছিল না ৷ সেসব দেখে অভয়ার সমস্ত অন্তর বিদ্রোহ করে উঠেছিল। ইতিমধ্যে রোহিণী তাঁকে ভালবেসে ফেলেছিলেন, এবং তাঁর সেই কামনা অব্যক্ত থাকেনি। অভয়া স্বামীত্বের আলেয়ার পিছনে আর বৃথা ধাওয়া না করে রোহিণীকে নিয়েই নিজের ঘর বেঁধেছিলেন, এবং তাঁরা স্বামী-স্ত্রীরূপে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। দাম্পত্য আদর্শের অভ্যস্ত মূল্যবোধে লালিত বাঙালী পাঠক-পাঠিকার পক্ষে এটা যে সাংঘাতিক একটা চমক, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই চমক সৃষ্টিকারী আচরণের যুক্তিও শরৎচন্দ্র অভয়ার জবানীতে জুগিয়েছিলেন। উপন্যাসে অভয়া শ্রীকান্তকে বলেছিলেন, “রোহিণীবাবুকে ত আপনি দেখে গেছেন। তাঁর ভালবাসা ত আপনার অগোচর নেই; এমন লোকের সমস্ত জীবনটাকে পঙ্গু করে দিয়ে আমি আর সতী নাম কিনতে চাইনে #শ্রীকান্তবাবু। … একটা রাত্রির বিবাহ অনুষ্ঠান যা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের কাছে স্বপ্নের মত মিথ্যা হয়ে গেছে, তাকে জোর করে সারা জীবন সত্য বলে খাড়া করে রাখবার জন্য এই এতবড় ভালবাসাটা একেবারে ব্যর্থ করে দেব? যে বিধাতা ভালবাসা দিয়েছেন তিনি কি তাতেই খুসি হবেন?” অন্যদিকে শরৎ-সৃষ্ট প্রখর বুদ্ধিশালিনী প্রদীপ্ত আগুনের শিখারূপিণী কিরণময়ী নামক চরিত্রটি যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত ভারতীয় নারীর পাতিব্রত্যের সংস্কার, আর সেই সংস্কারকে অস্বীকার করবার নির্ভীকতার অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত দ্বিধাপীড়িত নারীর একটি চমৎকার আলেখ্য বলে দেখতে পাওয়া যায়। ওই দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভার কিরণময়ীর মত সাহসিকা মননশীল নারীও শেষপর্যন্ত আর সহ্য করতে পারেন নি, তিনি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর পাগল হওয়ার বীজ তাঁর স্বভাবের অন্তর্নিহিত কনট্র্যাডিকশনের মধ্যেই নিহিত ছিল - সেজন্য শরৎচন্দ্রকে সেই বিষয়ে কোন দোষ দেওয়া বৃথা। সেক্ষেত্রে শরৎচন্দ্র একজন বাস্তববাদী শিল্পীর মতই কিরণময়ীর স্বভাবকে অনুসরণ করে তাঁর পরিণাম যা হতে পারত, সেটাই দেখিয়েছিলেন। নিজের পীড়ণেচ্ছার দ্বারা চালিত হয়ে তিনি কিরণময়ীকে তাঁর স্খলনের জন্য সেই শাস্তি দিতে যাননি, যেটা বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে কল্পনীয় ছিল। (বিষবৃক্ষের কুন্দ আর কৃষ্ণকান্তের উইলের রোহিণীর পরিণাম স্মরণীয়।) কিন্তু কিরণময়ীর জীবন স্বীয় অন্তর্দ্বন্দ্বের ভারে বিপর্যন্ত হয়ে ব্যর্থ হয়ে গেলেও বাংলা সাহিত্যে সেটা আজও এক অবিস্মরণীয় চরিত্র। কিন্তু এমন চরিত্র শরৎচন্দ্রের কলমেও বেশী ফোটেনি। পক্ষান্তরে শরৎচন্দ্রের কমল অন্ধস্বামীভক্তির একান্ত বশংবদ দাসীসুলভ আদর্শের কঠোর সমালোচক ছিলেন। তিনি ইউরোপীয় ক্ষণবাদের পূজারী ছিলেন; ভারতীয় সনাতন আদর্শের শাসিত, মনু প্রভৃতি বিধানদাতাদের দ্বারা জোর-করে-চাপানো পাতিব্রত্যের চিরস্থায়িত্বে তাঁর আস্থা কম ছিল। তিনি স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন অপেক্ষা স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসাকে বেশী মূল্য দিতেন, এবং সেই ভালবাসা যদি স্বল্পকালীনও হয়, তাহলেও সেটার উপরেই বেশী গুরুত্ব আরোপ করতেন। প্রেমহীন দাম্পত্যের বোঝা সারাটা জীবন নিষ্প্রাণভাবে বয়ে বেড়ানোর চেয়ে প্রেমপূর্ণ দু’দিনের দাম্পত্য তাঁর কাছে সমধিক কাম্য ছিল। তাঁর প্রতি শিবনাথের ভালবাসা যখন শিথিল হয়ে গিয়েছিল, তিনি তখন পত্নীত্বের দাবীতে শিবনাথের উপরে ভার হয়ে চেপে থাকেন নি, শিবনাথকে তিনি তাঁর নিজের রুচিমাফিক পথ ও প্রবৃত্তি অনুসরণ করবার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। একদিন শিবনাথের সঙ্গে মন্ত্র সাক্ষী রেখে বিয়ে হয়েছিল বলেই সেই নজীরে গোটা জীবন তাঁর উপরে স্ত্রীত্বের অধিকার খাটাতে যাবে, এমন হৃদয়ের সম্পর্ক শূন্য সম্পত্তির বোধ কমলের ছিল না। তাঁর প্রবল আত্মমর্যাদাই তাঁকে সেই অপমানকর অবস্থা থেকে সযত্নে রক্ষা করেছিল। আবার অন্য একদিন তিনি যখন অনুভব করতে পেরেছিলেন যে, তাঁর প্রতি অজিতের ভালবাসায় কোন খাদ নেই, সেই ভালবাসা নানা কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, তখন অজিতকে গ্রহণ করতে তাঁর আটকায় নি; যদিও কমল জানতেন যে, আশুবাবুর কন্যা মনোরমা এক সময়ে অজিতের বাগদত্তা ছিলেন। মনোরমা ও অজিতের মধ্যেকার ভালবাসার আকর্ষণ ফুরিয়ে গিয়েছিল বলেই কমল সেই শূন্যস্থান পূরণে আপত্তি করেন নি, নয়ত শত প্রলোভনেও তাঁকে সেই কাজে রাজী করানো যেত না।
এখানে শরৎচন্দ্র সৃষ্ট তিনটি বিদ্রোহিনী নারী চরিত্রের যে ছাঁচ আঁকা হল, সেটা থেকে মনে হতে পারে যে, শরৎচন্দ্র ভারতীয় সনাতন পাতিব্রত্য তথা একপত্নীত্বের আদর্শকে আঘাত করবার জন্যই এই চরিত্রগুলির পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু সেকথা ঠিক নয়। এই সব চরিত্র তাঁর শিল্প-পরিকল্পনার মধ্যে বিচ্ছিন্ন দৃষ্টান্ত হিসাবে এসেছিল; নিজের জীবনে বহুবিচিত্র নারী-পুরুষের সংস্পর্শে তিনি এসেছিলেন, তাঁদের থেকে বেছে এই চরিত্রগুলিকে তিনি বাংলা সাহিত্যে উপহার দিয়েছিলেন। নইলে তাঁর মনের পক্ষপাত কিন্তু বরাবরই ভারতীয় সনাতন হিন্দু একপত্নীত্বের আদর্শের দিকেই ছিল। হিন্দু দাম্পত্য আদর্শকে তিনি অত্যন্ত বড় করে - শুভদা, বিরাজবৌ, অন্নদাদিদি (শ্রীকান্ত প্রথম পর্ব), সুরবালা (চরিত্রহীন), কুসুম (পণ্ডিতমশাই), মৃণাল (গৃহদাহ) প্রভৃতি চরিত্রায়ণের সাহায্যে তুলে ধরেছিলেন। বিধবার পক্ষে প্রত্যক্ষের তো কথাই নেই, চিন্তাতেও পরপুরুষের ধ্যান করা যে অনুচিত, সেই ছবিটা তিনি তাঁর বড়দিদির মাধবী ও পল্লীসমাজের রমা চরিত্রগুলির মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। মৃণাল বিধবা হওয়ার পরে তাঁর উপরেও তিনি একই বরাত চাপিয়ে দিয়েছিলেন। শরৎচন্দ্র পূর্বোক্তা লীলারাণী গঙ্গোপাধ্যায়কে একটি চিঠিতে জানিয়েছিলেন যে, তিনি তাঁর বইতে একজন বিধবারও পুনর্বিবাহ ঘটাননি। কিন্তু কেন ঘটাননি, সেই কারণ তিনি অনুক্ত রেখেছিলেন। কারণটি বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন তিনি অনুভব করেননি। তবে বুদ্ধিগতভাবে তিনি যে বিধবাবিবাহের পক্ষপাতী ছিলেন, সেটার একাধিক নজির তাঁর চিঠিপত্রের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু বুদ্ধির সমর্থন আর হৃদয়ের অনুমোদন কখনোই এক হয় না। মানুষ উপরে-উপরে বুদ্ধি দিয়ে যা বিশ্বাস করে, সব সময় হৃদয় দিয়ে সেটাকে মেনে নিতে পারে না। সংস্কার সহজে মরতে চায় না। তাই কঠিন পরীক্ষার ক্ষেত্রে প্রায়ই সেটা বুদ্ধির যুক্তিকে নাকচ করে দেয়। শরৎচন্দ্রের ক্ষেত্রেও সেরকম কিছু একটা ঘটেছিল কিনা - সেটা একটা প্রশ্নচিহ্ন হয়েই থেকে গিয়েছে।
পথের দাবীর আখ্যানভাগে দেখতে পাওয়া যায় যে, স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার জন্য নবতারা তাঁর স্বামীকে ছেড়ে চলে এসেছিলেন। এরপরে কবি ও বেহালাবাদক শশীর সঙ্গে তাঁর বিয়ের সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু তারপরে হঠাৎই জানা গিয়েছিল যে, আহমেদ নামক এক মিলের টাইম-কিপার মুসলমান যুবককে বিয়ে করে তিনি শশীকে পথে বসিয়ে ছেড়েছিলেন। এই গল্পের সারমর্ম কি হতে পারে সেটা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অবকাশ থাকাই স্বাভাবিক, তবে গল্পটি থেকে লেখকের মনোগত অভিপ্রায়কে বোঝার ভুল সম্ভবতঃ হওয়ার কথা নয়। এটা নবতারা নামক একটি বিশেষ মেয়ের অনুচিত স্বাধীনচারিতার প্রশ্নই শুধু নয়, ন্যায়সঙ্গত কারণ ব্যতিরেকে যেকোন বিবাহিত নারীর স্বামী ত্যাগের অনৈতিকতাকেই সম্ভবতঃ এখানে ইঙ্গিতে সমালোচনা করবার চেষ্টা করা হয়েছে বলে দেখতে পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে, পথের দাবী উপন্যাসের আর কোথাও কিন্তু কোন মুসলমানের নামোল্লেখ পর্যন্ত নেই, কিন্তু হঠাৎই কথা নেই বার্তা নেই নবতারার কাহিনীতে ওই মেয়েটির স্বভাব-তারল্যকে ফুটিয়ে তোলবার জন্য কেন যে শরৎচন্দ্র একটি মুসলমান যুবকের আমদানী করেছিলেন, সেটা আজও সমালোচকদের কাছে মস্তবড় একটা ধাঁধা হয়ে রয়েছে। আসলে খেলাচ্ছলে অথবা কোন তুচ্ছ কারণে স্বামীকে ছেড়ে চলে আসবার চটুলতাকে শরৎচন্দ্র আদপেই সহ্য করতে প্রস্তুত ছিলেন না। অভয়ার ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্তের চিত্র আঁকা সত্ত্বেও এই ব্যাপারে তাঁর মনোভাব আপসহীন ছিল বলেই মনে হয়। পতিগতপ্রাণা নারীচরিত্রগুলিকে প্রাণের সমস্ত দরদ ঢেলে আঁকার মধ্যেই তাঁর সেই মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, অন্নদাদিদিকে তিনি কী মহীয়সী করেই না এঁকেছিলেন। স্বামীর শত অত্যাচারেও অন্নদাদিদির সতীত্ব কিন্তু টোল খায়নি। বিরাজের সতীত্বকে তিনি তাঁর সাময়িক বিভ্রম সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত অস্খলিত ও নিষ্কলুষ রেখেছিলেন। #স্বামী #উপন্যাস বাল্যপ্রণয়ের অজুহাতে পরপুরুষের প্রতি আকর্ষণের আবেগকে অশ্রদ্ধেয় প্রতিপন্ন করে শেষ পর্যন্ত স্বামিত্বের আদর্শকে খুবই বড় করে দেখানো হয়েছিল। অধঃপতিত স্বামীর হাতে বহুবিধ লাঞ্ছনা-বঞ্চনা সত্ত্বেও শুভদার অপার সহিষ্ণুতা, ক্ষমা-প্রবণতা নারীজাতির পক্ষে এক মহা-অনুকরণযোগ্য গুণরূপে ওই উপন্যাসে কীর্তিত হয়েছে। শুধুমাত্র স্বামীত্বকে গৌরবান্বিত করে তোলবার জন্য সরযূ ও কুসুমের স্বামী-পরিত্যক্তা হওয়ার কষ্ট চরম করে দেখানো হয়েছিল। দীর্ঘদিন বাদে জীবানন্দকে দেখবার ফলে ষোড়শীর মধ্যে লুপ্তপ্রায় স্বামীত্বের সংস্কার জেগে উঠেছিল। কিন্তু এসব বাহ্য ছিল। চরিত্রহীন উপন্যাসের সুরবালার মধ্যে শরৎচন্দ্র স্বামীত্বের গৌরবকে সবচেয়ে বড় করে দেখিয়েছিলেন। সুরবালার পতিভক্তির শক্তি ও পবিত্রতাকে তিনি এতটাই মহিমা দিয়েছিলেন যে, কিরণময়ীর মত বুদ্ধিশালিনী সনাতন শাস্ত্রশাসনের বিধিবিধান লঙ্ঘনকারিণী সাহসিকা রমণী সেই চরিত্রের সংস্পর্শে এসে একেবারেই যেন চকিতে বদলে গিয়েছিলেন। কিরণময়ীর মধ্যে যে অন্তর্সংঘাত দেখানো হয়েছিল, সেটার মূলেও ওই স্বামী অন্তপ্রাণ নারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব ছিল। সুরবালার স্বামীভক্তির প্রবলতা দেখে কিরণময়ী তাঁর মরণোন্মুখ স্বামীকে প্রাণভরে সেবা করতে শিখেছিলেন। তাঁর স্বামীকে যদিও বাঁচানো সম্ভব হয়নি, তবুও তখন থেকেই সেই নারীর জীবনে বুদ্ধির সঙ্গে হৃদয়ের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল। কিন্তু উপন্যাসটির ট্র্যাজেডি এখানেই যে, কিরণময়ী সেই দ্বন্দ্বের কোন মীমাংসা করতে পারেন নি। ওই দ্বন্দ্বের ফলেই শেষপর্যন্ত তাঁর মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছিল।
এই প্রবন্ধের শুরুর দিকেই বলা হয়েছে যে, শরৎচন্দ্র মূলতঃ ব্যক্তির স্বাধীনতার পক্ষপাতী ছিলেন, কিন্তু পারিবারিক ক্ষেত্রে এলেই তাঁকে অন্যরূপে দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে তিনি মূলতঃ রক্ষণশীল ছিলেন। সনাতন ভারতীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম ও আচার-প্রথাই যেন গার্হস্থ্য জীবনের স্তরে তাঁর সবচেয়ে বেশি মনোহরণ করেছিল। যদিও সেই সঙ্গে একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, তাঁর রক্ষণশীলতাও তাঁর শিল্পসৃষ্টির গুণে পরম আস্বাদ্য হয়ে উঠেছে। পক্ষান্তরে বৃহত্তর সামাজিক প্রশ্নে কখনও তিনি রক্ষণশীল, তো কখনও আবার প্রগতিশীল হয়ে উঠেছিলেন। সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির সংঘাতের প্রশ্নে কখনও তিনি সমাজকে জয়ী করেছিলেন (যেমন, রমার ও সাবিত্রীর ক্ষেত্রে), তো কখনও আবার ব্যক্তিকে জয়ী করেছিলেন (যেমন, অভয়ার ক্ষেত্রে)। এই মিশ্র মানসিকতার জন্য তাঁর ব্যক্তিক স্বভাবের গঠন দায়ী ছিল, যেটার মূলে তাঁর কৌলিক সংস্কার অনেকটাই কাজ করেছিল। তাছাড়া, তাঁর বাস্তববাদও ওই ধরণের দ্বৈধতার একটি প্রধান কারণ ছিল। একজন শিল্পী হিসাবে #শরৎচন্দ্র মূলতঃ বাস্তববাদী ছিলেন। তিনি একাধিক জায়গায় বলেছিলেন যে, তিনি কোন সমাজ-সংস্কারক নন, তখনকার সমাজে সত্যি সত্যি যা ঘটেছিল, সেগুলোকে একটা রূপ দিয়েই তিনি খালাস হয়েছিলেন। সেকালের সমাজে যেসব সমস্যা ছিল, সেগুলোর প্রতি তিনি সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন; কিন্তু সেই সমস্যাগুলো সমাধানের ভার তিনি নেননি। অবশ্য একজন শিল্পী হিসাবে সেটা তাঁর কৃত্যও ছিল না। যেহেতু তিনি একজন শিল্পী ছিলেন, সেহেতু সমাজের প্রকৃত চেহারাটা ফুটিয়ে তুলতে পারলেই তাঁর কর্তব্য সমাধা হয়ে গিয়েছিল। তবুও এরই মধ্যে কখনও কখনও শরৎ-মানসের প্রগতিশীল ছবিটি ঝিলকিয়ে উঠেছিল। তিনি যেন কোন কোন ক্ষেত্রে সমাধান দেওয়ার কিনারায় পৌঁছে গিয়েছিলেন বলেই মনে হয়। কৌলীন্য প্রথা যে একটি অত্যন্ত অশ্রদ্ধেয় ক্ষতিকর প্রতিষ্ঠান, সেটা তিনি তাঁর বড় গল্প বামুনের মেয়ে-তে বেশ ভাল করেই দেখিয়ে দিয়েছিলেন। মেল-প্রবর-গাঁই-গোত্র মেলাবার ব্যর্থ চেষ্টায় উদ্যমক্ষেপ ও সময় নষ্ট না করে বর ও কন্যার স্বেচ্ছা-নির্বাচনের ঔচিত্য ও সুস্থতাকে তিনি তাঁর অরক্ষণীয়া উপন্যাসের জ্ঞানদা ও অতুলের পারস্পরিক আকর্ষণকে শেষ পর্যন্ত জয়ী করে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তেমনি দত্তা উপন্যাসে বিজয়া ও নরেনের পারস্পরিক স্বাভাবিক আকর্ষণকে তিনি মর্যাদা দিয়েছিলেন, ও পরিণামে সেটাকে বিবাহের শীলমোহর দিয়ে বিলাসের সঙ্গে বিজয়ার বাগদত্তা হওয়ার কৃত্রিমতাকে অগ্রাহ্য করে পাকা করে তুলেছিলেন। আহারাদির বাছবিচার নিয়ে তাঁর অত যে খুঁতখুঁতে বাই ছিল, তাঁর গল্পোপন্যাসে ছোঁয়াছুঁয়ির প্রসঙ্গ একটা সদাবিদ্যমান ধুয়োর মত বারেবারেই ফিরে এসেছিল। তাঁর গৃহদাহ উপন্যাসের শেষটি পড়লে কিন্তু মনে হয় যে, ছোঁয়াছুঁয়ির অন্তঃসারশূন্যতাই তাঁর প্রতিবাদ্য ছিল। অন্ততঃ সেই উপন্যাসে সেটা যে প্রতিবাদ্য ছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। রামবাবু তো হিন্দুধর্মের মহিমা প্রকটনের উদ্দেশ্যেই অচলার কাছে স্বপাক আহারের উপযোগিতা, শুদ্ধাচারী হয়ে চলবার উপযোগিতা, হিন্দুর স্বধর্মনিষ্ঠায় স্থিত থাকবার সার্থকতা ইত্যাদি বিষয়ে কত গালভরা কথাই বলেছিলেন; কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি যখন জানতে পেরেছিলেন যে, না জেনে তিনি এক বিধর্মী ব্রাহ্মকন্যার হাতের পাক অন্ন গ্রহণ করেছেন, তখন তাঁর সদাশয়তার খোলসটা আর বজায় থাকেনি। সুরেশকে মৃত্যুশয্যায় শায়িত ও অচলাকে নিতান্ত অপরিচিত পরিবেশে অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলে রেখে তিনি তক্ষুণি প্রায়শ্চিত্তবিধানের জন্য তড়িঘড়ি কাশীতে ছুটে গিয়েছিলেন। লেখক সেখানে প্রকারান্তরে সংস্কারান্ধতার ক্রূরতাটাকেই #পাঠক-পাঠিকার চোখে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। ওই কাহিনীর সমাপ্তিতে তিনি মহিমের মুখে যে ভাবনা বসিয়েছিলেন, সেটা থেকেও এই ধারণার সমর্থন পাওয়া যায়। মহিম মনে মনে ভেবেছিল - “কিন্তু এই আচারপরায়ণ ব্রাহ্মণের এই ধর্ম কোন সত্যকার ধর্ম, যাহা সামান্য একটা মেয়ের প্রতারণায় এক নিমিষে ধূলিসাৎ হইয়া গেল, যে ধর্ম অত্যাচারীর আঘাত হইতে নিজেকে এবং অপরকে রক্ষা করিতে পারে না, বরঞ্চ তাহাকেই মৃত্যু হইতে বাঁচাইতে সমস্ত শক্তি অহরহ উদ্যত রাখিতে হয়, সে কিসের ধর্ম এবং মানব-জীবনে তাহার প্রয়োজনীয়তা কোনখানে? যে ধর্ম স্নেহের মর্যাদা রাখিতে দিল না, নিঃসহায় আর্ত নারীকে মৃত্যুর মুখে ফেলিয়া যাইতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করিল না, আঘাত খাইয়া যে ধর্ম এতবড় স্নেহশীল বৃদ্ধকে এমন চঞ্চল প্রতিহিংসায় এরূপ নিষ্ঠুর করিয়া দিল, সে কিসের ধর্ম? ইহাকে যে স্বীকার করিয়াছে, সে কোন সত্য বস্তু বহন করিতেছে? যাহা #ধর্ম সে ত বর্মের মত আঘাত সহিবার জন্যই! সেই তো তার শেষ পরীক্ষা!” (শরৎ-সাহিত্য সংগ্রহ, সপ্তম সম্ভার, পৃ: ২৬২-৬৩) এটা থেকে পরিষ্কার মনে হয় যে, শরৎচন্দ্র ধর্মের নামে আচার-বিচার ছোঁয়াছুঁয়ির বাড়াবাড়িকে কখনও যথার্থভাবে সমর্থন করতে পারেননি। তিনি ধর্মের মূলবস্তুকে ধর্মের সারাৎসার বলে নির্দেশ করতে চেয়েছিলেন - সেটার আনুষ্ঠানিকতা কিংবা আচারকে নয়। কিন্তু শরৎ-সাহিত্য পূর্বাপর অনুধাবন করলে এই বিষয়ে সংশয় যেন কিছুতেই ঘুচতে চায় না। উপরের উদ্ধৃতিতে লেখকের যে মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে, সেই মনোভাবের সঙ্গে তাঁর রচনা কিন্তু সর্বত্র সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলেনি বলেই দেখতে পাওয়া যায়। আহারের বাছবিচার নিয়ে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলির অনেকগুলিরই এত বেশি মাথাব্যথা যে, সন্দেহ হয়, সেই মাথাব্যথার খানিকটা গ্রন্থকারের নিজের মাথাব্যথারই প্রক্ষেপণ ছিল কিনা! শরৎ-সাহিত্যে ব্রাহ্মণত্বের তথাকথিত মহিমা ও শ্রেষ্ঠত্বের ভাবটিকে পরিস্ফুট করবার চেষ্টা এতটাই প্রকট, এবং সেটা নিয়ে চিত্র-চরিত্রের এত ছড়াছড়ি যে, কখনও কখনও ওই স্বাজাত্যাভিমান রীতিমত বিসদৃশতার কোঠায় গিয়ে পড়ে। ব্রাহ্মণের পৈতের প্রতি শরৎচন্দ্রের বড় মায়া ছিল - এমনতর মায়ায় বদ্ধ হয়েই তিনি একাধিক বৈপ্লবিক চরিত্রের স্রষ্টা হয়েও সমালোচকদের চূড়ান্ত বিচারে সংকীর্ণ প্রাদেশিকতা কিংবা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে উঠতে পারেন নি।
ব্রাহ্ম সমাজের প্রতি তাঁর বড়ই অনীহা ছিল। কথায় বলে, যে যে ভাবে মানুষকে দেখতে চান, সে সেই ভাবেই তাঁকে চিত্রিত করেন। #ব্রাহ্ম সমাজের প্রতি বিরাগ প্রদর্শনের জন্যই তিনি যেন দত্তার রাসবিহারী চরিত্রটিকে ইচ্ছা করেই বেশি বেশি কালির পোঁচ দিয়ে কালিমালিপ্ত করে এঁকেছিলেন। গৃহদাহের কেদারবাবুর অর্থলোলুপতাকে চিত্রিত করবার পিছনেও তাঁর সেই একই উদ্দেশ্য কাজ করেছিল বলে অনেকে সন্দেহ করে থাকেন। কোন মহৎ শিল্পীর মধ্যে এই ধরনের সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণচিত্ততা কিন্তু সহজে ভাবতে পারা যায় না। রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসের পরেশবাবুর ঔদার্যের সঙ্গে তুলনা করলেই বুঝতে পারা যাবে যে, এই চরিত্র দুটির অসম্পূর্ণতা ও অসঙ্গতি কোথায়। কুটকচালে বুদ্ধি ও অর্থলোলুপতা কোন একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই #সীমাবদ্ধ নয় যে, সেই দুটি দোষ দেখাবার জন্য একটি বিশেষ সম্প্রদায়কেই বেছে নিতে হবে। ব্রাহ্ম সমাজের নেতারা হিন্দু সমাজের প্রচলিত গণ্ডী ত্যাগ করে বাইরে বেরিয়ে এসে ধর্মসংস্কার করতে চেয়েছিলেন বলে শরৎচন্দ্র কোন সময়েই তাঁদের ক্ষমা করতে পারেননি। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে একবারও তাঁর এই কথাটা খেয়াল হয়নি যে, #ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গদেশে শিক্ষায়, সমাজ সংস্কারে, রাজনৈতিক চেতনার জাগরণে, সাহিত্যে, স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারে, একাধিক কুপ্রথার (যথা - বাল্যবিবাহ, নারীনিগ্রহ, সুরাপান ইত্যাদি) মূলোচ্ছেদ করবার চেষ্টায় ওই ব্রাহ্ম সমাজই সবচেয়ে অগ্রণীর ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাংলার মানুষের গর্বের কোন শেষ নেই, তিনিও ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত মানুষ ছিলেন। যদিও একথা বলাই বাহুল্য যে, কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মসম্প্রদায়ের ছাপ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের মত বড় মনের একজন মানুষকে চিহ্নিত করতে যাওয়ার চেষ্টা বৃথা। শরৎচন্দ্র অনেক জায়গায় ঘুরে অনেক মানুষের সঙ্গ ও অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবার পরেও কেমন করে অমন অনুদার থেকে যেতে পেরেছিলেন - সেটা অবশ্যই একটি স্থায়ী প্রশ্ন। যাই হোক, এই সব ত্রুটি-বিচ্যুতি অসম্পূর্ণতা অসঙ্গতির প্রশ্ন বাদ দিলে শরৎচন্দ্র সত্যিই কিন্তু এক অসামান্য #শিল্পী। তাঁর দরদের কোন তুলনা হয় না। তাঁর ভাষা ও ভঙ্গি চেখে চেখে ভোগ করবার মত এক পরম স্বাদু বস্তু। পল্লীভিত্তিক উপন্যাস-গল্প রচনাতেই তাঁর সৃষ্টির শিল্পোৎকর্ষ সবচেয়ে বেশী প্রকাশ পেয়েছিল, কিন্তু তাঁর ভাষাটি পুরোপুরি নাগরিক মেজাজের ছিল। তাঁর সম্পর্কে হতবুদ্ধি হয়ে লক্ষ্য করবার মত একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল যে, যে-গোঁড়ামি ও সংরক্ষণকামিতার জন্য সমালোচকরা বারে বারে তাঁর সমালোচনা করেছেন, সেই গোঁড়ামি ও সংরক্ষণশীলতার আধারে রচিত তাঁর পারিবারিক গল্প-উপন্যাসগুলিতেই কিন্তু তাঁর শ্রেষ্ঠ শিল্পোৎকর্ষ ব্যঞ্জিত হয়েছে বলে দেখতে পাওয়া যায়। অন্যদিকে তাঁর মননশীল বইগুলি কিন্তু পাঠক-পাঠিকা চিত্তের উপরে তেমনভাবে দাগ কাটতে পারেনি। তাঁর পথের দাবী উপন্যাসটিকে সেই ব্যর্থতার একটি নিদর্শন হিসেবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। সমালোচক নারায়ণ চৌধুরীর বক্তব্যে, “উপন্যাসটির আরম্ভ হয়েছিল অতি চমৎকারভাবে, সেই যেখানে সব্যসাচী গেঁজেল গিরিশ মহাপাত্র রূপে রেঙ্গুনের জেটিতে আত্মপ্রকাশ করছে ও পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে সটকে পড়ছে, সেই অংশটির কোন তুলনা নেই। কিন্তু তার পরেই যেন বইটি কেমন মিইয়ে গেছে। রাষ্ট্র-বিপ্লব সম্পর্কে সব্যসাচীর গালভরা বুলিগুলিও পড়তে ভালই লাগে, কিন্তু ভারতীর সঙ্গে বসে বসে অন্তহীন কথার কচকচি এক এক সময়ে রীতিমত বিরক্তিকর ঠেকে। সব্যসাচীকে যদি একজন দরদী মানবতাবাদী চরিত্র রূপে আঁকাই লেখকের উদ্দেশ্য ছিল, তাহলে সূচনায় এমন কঠিন বিপ্লবের গৌড়-চন্দ্রিকা ফাঁদা হয়েছিল কেন? বইটা একেবারেই মাঠে মারা গেছে অপূর্ব-ভারতী জুটির তুচ্ছ আকর্ষণ-বিকর্ষণের পালার বর্ণনায় পাতার পর পাতা ভরাতে গিয়ে। … তবু সব্যসাচীর কথাগুলির দাম আছে। এই থেকে শরৎচন্দ্রের রাষ্ট্রিক চিন্তার কাঠামোর একটা আভাস পাওয়া যায়। এই উপন্যাসের বক্তব্য ও অন্যান্য রচনাংশ থেকে মনে হয়, শরৎচন্দ্র অহিংসা তত্ত্বের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন না, দেশের স্বাধীনতা ও তৎপরবর্তী সমাজ বিপ্লব সাধনের জন্য সশস্ত্র পন্থার কার্যকারিতাতেই তাঁর সমধিক বিশ্বাস ছিল। তবে তাঁর চোখে রক্তারক্তিটাই বিপ্লব নয়, বিপ্লব মানে একটা ‘দ্রুত আমূল পরিবর্তন’ (সব্যসাচী)। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে দেখা যায়, তাঁর এই বক্তব্যের সঙ্গে তাঁর পারিবারিক উপন্যাসগুলির দৃষ্টিভঙ্গির আদৌ কোন মিল নেই। শরৎচন্দ্রের পারিবারিক উপন্যাসগুলির পটভূমিকায় পথের দাবী বা এই জাতীয় রচনা যেন একটা বিচ্ছিন্ন শিল্পকর্ম রূপে আলাদা হয়ে ঝুলে আছে। শরৎচন্দ্র মূলতঃ সামন্ততান্ত্রিক ভূমিব্যবস্থায় লালিত ছায়াচ্ছন্ন পল্লীর গার্হস্থ্য জীবনের শিল্পী, তাঁর শিল্পের পরিকল্পনার মধ্যে একটা পথের দাবী কিংবা একটা শেষ প্রশ্ন উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। এই দুই ধরনের রচনা কর্মের মধ্যে না আছে মেজাজের মিল, না চিত্তা-কল্পনার সামঞ্জস্য। একের বক্তব্য অন্যে খারিজ হয়ে যাচ্ছে। নিষ্কৃতি-পল্লীসমাজ-পণ্ডিতমশাই-অরক্ষণীয়ার লেখকের সঙ্গে পথের দাবী-শেষ প্রশ্নের লেখককে ঠিক কেমন যেন মেলানো যায় না।”
(তথ্যসহায়ক গ্রন্থাবলী:
১- শরৎ-সাহিত্য সংগ্রহ।
২- শরৎচন্দ্র সমালোচনা সাহিত্য, সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত।
৩- শরৎ-সাহিত্যের মূলতত্ত্ব, বিশু মুখোপাধ্যায়।
৪- শরৎচন্দ্রের চিঠিপত্র, গোপালচন্দ্র রায়।
৫- শরৎচন্দ্র, গোপালচন্দ্র রায়।
৬- কথা সাহিত্য, নারায়ণ চৌধুরী।)
নিচের হ্যাস ট্যাগ গুলো ব্যবহার করুন:
#Bangladesh #Bangla #Bengali #Dhaka #Bangladeshi #Kolkata
#বাংলাদেশ #বাংলা #বাঙালী #ঢাকা #বাংলাদেশী #কলকাতা